আমরা ইসলামশূন্য সমাজে বাস করি । এখানে অধিকাংশ মুসলিম ইসলামবিমুখ । আর সংখ্যালঘু দ্বীনপালনকারী মুসলিমরা নানান ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘরানায় বিভক্ত । তাদের ইলমচর্চাও বলয়বেষ্টিত । এখানে তাই ইসলাম শেখার স্বাভাবিক সুযোগ নেই । নেই বলয়মুক্ত কুরআন-হাদীস চর্চা । এই ইসলামহীন মুসলিম সমাজে একটা শিশু ইসলামের জ্ঞানশূন্যভাবেই বেড়ে ওঠে । এভাবে বড় হতে হতে বড়জোর তার ভাণ্ডারে ইসলাম সম্পর্কে ভাসাভাসা ভুলভাল কিছু তথ্য জমা হতে পারে হয়তো । যা তাকে ইসলাম বুঝতে নয়, বরং ইসলাম থেকে দূরে সরাতেই সাহায্য করে । তারপর জীবনের কোনো পর্যায়ে গিয়ে যখন সে কোনো কারণে দ্বীনমুখী হতে চায়, দেখা যায়, কোনো না কোনোভাবে সে কোনো এক ঘরানার হাতে গিয়ে পড়ে । এতদিন যেহেতু ইসলাম সম্পর্কে তার তেমন কোনো জ্ঞান ছিল না, এখন বলয়বদ্ধ হয়েই তার ইসলাম শেখা শুরু, একারণে ধীরে ধীরে তার চোখে একটা ‘দল-রঙিন চশমা’ সেঁটে যেতে থাকে এবং এ চশমার চোখ দিয়েই সে ইসলাম ও মুসলিমকে বুঝতে ও দেখতে শেখে ।
তাই দেখা যাবে, এই বলয়ে যদি ইসলামের কোনো ফরয-ওয়াজিব বিধানকে নফল-মুস্তাহাবের গুরুত্ব দেয়া হয়, তার কাছেও তা নফল মুস্তাহাবের গুরুত্ব পাবে । আবার ইসলামের কোনো জায়িয-নফল- মুস্তাহাব যদি সেখানে ফরয-ওয়াজিবের গুরুত্ব দিয়ে চর্চা হয় সে সেটাকে ফরয-ওয়াজিবের গুরুত্ব দিয়েই পালন করবে । সেখানে যদি ইসলাম খণ্ডিতরূপে চর্চিত হয়, তার কাছে ওই খণ্ডাংশই পূর্ণাঙ্গ দ্বীন বলে বিবেচিত হবে । আর দ্বীনের বাকি অংশ যত গুরুত্বপূর্ণই হোক তার কাছে তা গুরুত্বহীন বা অবজ্ঞার বিষয় বলে মনে হবে । এভাবে দেখা যাবে যে, সে ‘দ্বীনের জন্য ঘৃণা করা’র নামে বিশুদ্ধভাবে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন পালনকারী মুসলিমকে ঘৃণা করতে থাকবে । এক্ষেত্রে সাধারণ ও বিশেষের মাঝে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো পার্থক্য দেখা যায় না ।
চশমার চোখে দেখার কারণে আরেকটা মজার বিষয় আমাদের সমাজে ঘটে । বিশুদ্ধ দলীলের দৃষ্টিতে সমান পর্যায়ের দুটি বিষয়- একটি আমাদের ঘরানায় চর্চিত, অন্যটি অন্য ঘরানায় । তখন আমরা আমাদের ঘরানায় চর্চিত বিষয়টিকে বিভিন্নভাবে যুক্তি-উক্তির অবতারণা করে নিদেনপক্ষে জায়িয, মুস্তাহাব বা সুন্নাত বানানোর চেষ্ট করি । আর অন্যটির বেলায় ঠিক বিপরীত আচরণ করি । নানানভাবে যুক্তি দিয়ে সেটিকে অবৈধ, মাকরুহ বা বিদআত বলে প্রমাণ করতে থাকি ।
ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহ. তাঁর ‘এহইয়াউস সুনান’ গ্রন্থে এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের নাভিমূলে শক্তভাবে আঘাত হেনেছেন । শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সর্বজনমান্য একক মূলনীতির আলোকে সকল আমল বিশ্লেষণ করেছেন । আর এ কারণেই বইটি ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয় । কেননা আমাদের দ্বীনদার ও বিদ্বান শ্রেণি তো নিজের মত ও মতাদর্শ টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনে মূলনীতিই পাল্টে ফেলেন । প্রথম পাঠে আমার কাছে যে সমস্যার কথা মনে হয়েছিল তা এ চশমার কারণেই ।
সত্য জানার পরও তা অগ্রাহ্য ও সমালোচনা করার একটা কারণ হলো ঘরানাবদ্ধ হবার পর চোখে দলরঙা চশমা লেগে যাওয়া এবং খোলা চোখে বাস্তবতা দেখার সৌভাগ্য হারিয়ে ফেলা । দ্বিতীয় যে কারণটি এ ক্ষেত্রে কার্যকর, তাও নিরপেক্ষভাবে ইসলাম শেখার আগে ঘরানাবদ্ধ হওয়া থেকেই তৈরি হয় । সেটি স্যার তাঁর ‘সালাতুল ঈদের অতিরিক্ত তাকবীর’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন । তিনি লেখেন ‘মানুষের অন্যতম দুর্বলতা হল, একবার কোনো মত গ্রহণ করলে তা পরিত্যাগ করাকে ব্যক্তিগত পরাজয় বলে মনে করা । এজন্য অনেক মানুষই দ্বীনের ক্ষেত্রে দলীল প্রমাণাদি জানার পরেও বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে নিজের মতকেই বিজয়ী করার চেষ্টা করতে থাকেন’ । (ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, সহীহ হাদীসের আলোকে সালাতুল ঈদের অতিরিক্ত তাকবীর, পৃষ্ঠা: ৯৫, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০১৩, আস–সুন্নাহ পাবলিকেশন্স, ঝিনাইদহ । )
স্যার অবশ্যই সমালোচিত ও বিতর্কিত ছিলেন । যোগ্যতা, গ্রহণযোগ্যতা, জনপ্রিয়তা, সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা, সমাজের সংস্কার প্রচেষ্টায় ও মানব কল্যাণে নিবেদিত তাঁর পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের জন্য সমালোচিত ও বিতর্কিত হওয়া ইতিহাসের স্বাভাবিক ধারাবাহিক ও অনিবার্য বাস্তবতা । এটি ওই ব্যক্তিত্বের জন্য খুবই ইতিবাচক বিষয় । ‘সমালোচিত’ ও ‘বিতর্কিত’ শব্দ দুটি শুনেই আমরা যে নেতিবাচক ধারণায় নিপতিত হই, সেটি আমাদের শব্দের ব্যবহার ও ইতিহাস অজ্ঞতার ফল । ইতিহাস তো কোনো ব্যক্তির কর্মের দক্ষতা ও ব্যাপকতার আন্দায করে থাকে তার উপর সমালোচনার পরিধি দিয়েই ।
স্থান ও কালের বিবেচনায় আমি স্যার কে যুগের ‘ইবন তাইমিয়া’ মনে করি । সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদবি রাহ. তাঁর ‘তারীখে দাওয়াত ও আযীমাত’ সিরিজের আস্ত একটি খণ্ড বরাদ্দ করেছেন এই মহান ইমামের জন্য । তিনি ইবন তাইমিয়া’র অব্যবহিত পূর্বযুগের বিভিন্ন অবস্থার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বারবার একজন মর্দে কামিলের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন । তিনি দর্শনের বিদ্রোহ ও ইলমে কালামের ভারসাম্যহীনতা, খ্রিস্টানদের সামরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রুসেড, বাতিনিয়া ফিরকার ভ্রষ্টতা, আমজনতার গাফলত, বিদআত ও শিরক লিপ্ততা, তাসাউফপন্থিদের গোমরাহি, জ্ঞানী ও পণ্ডিত মহলের বন্ধ্যাত্ব ও স্থবিরতা এবং মাযহাবি গোঁড়ামি ও দলবাজি ইত্যাদি ফিতনার প্রত্যেকটার আলাদা আলাদা উল্লেখ করেছেন এবং তার মুকাবালায় একজন মুজাদ্দিদের প্রয়োজনীয়তা ও তার প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও গুণাবলির বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে শেষে পূর্ণ আস্থার সাথে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, “অষ্টম শতাব্দীতে এমনই একজন মর্দে কামিলের প্রয়োজন ছিল যিনি জীবনের সকল ক্ষেত্রে হবেন মর্দে মুজাহিদ, যাঁর সংগ্রাম-সাধনা, ও যাঁর সংস্কার কোনো একটিমাত্র শাখাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না । শাইখুল ইসলাম হাফিয ইবন তাইমিয়া রাহ. ছিলেন তেমনই এক ব্যক্তিত্ব” । (সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদবি সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠাঃ ১৭-২৪; দ্বিতীয় প্রকাশ ২০০৩ খ্রী.; মুহাম্মদ ব্রাদার্স, ঢাকা ।)
এই সামগ্রিক কামালিয়াতের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ইবন তাইমিয়া রাহ. ইসলামের ইতিহাসে বিতর্কিত ও সর্বাধিক মযলুম ইমাম হিসেবে খ্যাত । তাঁকে নিয়ে বিতর্ক ও তাঁর প্রতি যুলুম তাঁর জীবিতকালেই শুরু হয়েছিল । সেযুগের সর্বসাধারণ, আলিম-উলামা ও শাসক মহলের পক্ষ থেকে তিনি বহুবিধ যুলুমের শিকার হন ।
উভয় স্থান-কাল ও পাত্রের মাঝে আশ্চর্যজনক সামঞ্জস্যতা রয়েছে । সেকালের ফিতনাসমূহ আমাদের এই কালে এই ভূখণ্ডেও খানিকটা রূপ পাল্টে হুবহু বিদ্যমান । আর ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহ. যুগচাহিদা অনুযায়ী যুগের ভাষায় যথাযথ দক্ষতা ও সাহসিকতার সাথে সকল ফিতনা মুকাবালা করেছেন । সুতরাং তিনি ইমাম ইবন তাইমিয়া রাহ.র মতো বিতর্ক ও যুলুমের পাত্র হবেন এটা স্বাভাবিক । ইবন তাইমিয়া রাহ. এর বিরোধিতা, তাঁকে নিয়ে সমালোচনা ও বিতর্ক এবং তাঁর উপর যুলুমের আটটি কারণ উল্লেখ ও ব্যাখ্যা করেছেন সকল হাসান আলী মিয়া নদবি রাহ. । পাঠক, তাঁর ‘তারীখে দাওয়াত ও আযীমাত’ থেকে সংশ্লিষ্ট অংশটুকুর (১৫৩-১৬৯ পৃষ্ঠা) অধ্যয়ন আপনাকে স্যারের বিরোধিতার ব্যাপারটিও বুঝতে সাহায্য করবে । সেখান থেকে আমরা শুধু একটি কারণ এবং অতিরিক্ত আরেকটি কারণ উল্লেখ করব, যা ইবন তাইমিয়া ও স্যার এর বিতর্কিত হওয়ার যথার্থ কারণসমূহের অন্তর্ভূক্ত ।
হাসান আলী নদবি রাহ. বলেন, ‘প্রথমত, তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার এটাই প্রমাণ যে, তাঁর ব্যক্তিসত্তা সম্পর্কে শুরু থেকেই দুটি পক্ষ সৃষ্টি হয়েছে এবং দু’পক্ষের ভেতর প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সংঘর্ষ চলছে । ইতিহাসে যাঁরাই বিশিষ্ট আসন লাভ করেছেন এবং যাঁরাই অস্বাভাবিক ও অত্যাশ্চর্য কামালিয়াতের অধিকারী হয়েছেন তাঁদের সম্পর্কে হামেশাই এমনটি ঘটতে দেখা গেছে । একদল তাঁদের ভক্তে পরিণত হয়েছে, যারা তাঁদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছে এবং প্রশংসার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির আশ্রয় নিয়েছে । অন্যদল তাঁদের বিরোধিতা ও সমালোচনায় কোমর বেঁধেছে এবং সেক্ষেত্রে তারা বাড়াবাড়ির চূড়ান্ত করে ছেড়েছে । আযীমুশ্বান ও অস্বাভাবিক ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে ইতিহাসের এটি এমন এক ধারাবাহিক ও পর্যায়ক্রমিক অভিজ্ঞতা যে, ইতিহাস, দর্শন ও মনস্তত্ত্ববিদ্যার কতক অধ্যাপক এবং শ্রেষ্ঠ ও ক্ষণজন্মা প্রতিভার পর্যবেক্ষক একে স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবে অভিহিত করেছেন’ । (সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদবি, সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৫৩ ।)
কোনো সমাজ যখন বিদআত-কুসংস্কার, অধপতন ও অবক্ষয়ের দিকে যেতে থেকে, যাদের ইঙ্গিত বা নেতৃত্বে এই রসাতলযাত্রা; যারা পতনকে মেনে নেন এবং এই পতন, অবক্ষয় ও অসুস্থতাকেই বিভিন্নভাবে সঠিকতা, তরক্কি ও সুস্থতা বলে প্রমাণ করতে থাকেন, সমাজে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অসন্তোষ বা বিদ্রোহ দেখা যায় না, বরং সমাজ অবচেতনে তাদের নেতৃত্ব ও ইমামত কবুল করে নেয় এবং তাদের সতীর্থ ও সহযোগী হয়ে যায় । পক্ষান্তরে কোনো দরদি মানুষ যখন এই রোগ ও অবক্ষয়ের সংস্কার ও চিকিৎসা চান এবং সে মর্মে নিজেকে বিলীন করে দেন, জান কুরবান করেন সমাজের কল্যাণ, উপকার ও সংশোধনের জন্য, সমাজ তাকে শত্রু বলে আখ্যায়িত করে এবং তার বিরোধিতা ও তাকে প্রতিহত করতে কোমর বেঁধে একজোট হয়ে দাঁড়িয়ে যায় ।
ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহ. ছিলেন একজন দরদি মানুষ । সমাজ ও মানুষের অধপতন ও অবক্ষয় তাঁকে ব্যথিত ও বিচলিত করত । অধপতনকে উত্তরণ বলে চালিয়ে দিয়ে তিনি সস্তা বাহবা কুড়াতে চান নি । তিনি চেয়েছিলেন নিজেকে নিঃশেষ করে উম্মাহর কল্যাণ। তাই কুরআন-হাদীসকে দূরবর্তী ব্যাখ্যার মাধ্যমে মানুষের মনঃপূত করে সমাজের কাছাকাছি না এনে তিনি সমাজকেই কুরআনের কাছে আনার চেষ্টা করেছেন । সুন্নাহর কাছাকাছি টেনে আনার চেষ্টায় যুগসংস্কারকের যে দায় থাকে তিনিও বহন করেছেন সেই দরদ ও দায় । সে কারণেই ভালোবাসা ও প্রশংসার সমান্তরালে তিনি পেয়েছেন নিন্দা ও সমালোচনা ।
আরব বণিক ও দাঈ-মুবাল্লিগের মাধ্যমে আমাদের এ ভূখণ্ডে ইসলাম এসেছে হাজার বছর আগেই । তাদের দাওয়াত ও চরিত্র মাধুর্যে দলেদলে মানুষ তাওহীদের কালিমা গ্রহণ করেছে। কিন্তু যুগবাস্তবতা, শিক্ষক ও শিক্ষাপোকরণ এবং কিতাবাদির অপ্রতুলতার কারণে এই বিস্তৃত ভূখণ্ডের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে ইসলামের যথার্থ শিক্ষা যথাযথভাবে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয় নি। এভাবেই চলেছে যুগের পর যুগ । ইসলাম ভুল ও খণ্ডিতভাবে চর্চিত হয়েছে বৃহৎ সমাজে । কিছু দক্ষ ও যোগ্য আলিম তৈরি হয়েছে বটে । কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা এতটাই অপ্রতুল যে, তারা সর্বশক্তি দিয়ে যথাসাধ্য করার পরও সমগ্র সমাজকে ইসলামের পূর্ণ শিক্ষার আলোকে আনতে সক্ষম হন নি । এদেশের মানুষ ইসলামকে গ্রহণ করেছে আবেগ ও ভালোবাসায় । শতশত বছর ধরে প্রজন্ম পরম্পরায় বিভিন্ন সংস্কারকে তারা পালন করেছে আবেগ, ভালোবাসা ও পরকালীন মুক্তির আশায় । সুতরাং আবেগ ও অজ্ঞতাপূর্ণ সমাজে শুদ্ধতার তাবলীগ ও তাজদীদের এই যে প্রতিক্রিয়া, এটা সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি মাত্র, নতুন কোনো কিছু নয় ।
মুবাল্লিগ-মুজাদ্দিদকে মানুষের জন্মগত স্বভাব-প্রকৃতি যেমন বুঝতে হয় তেমনি সামনে রাখতে হয় ইতিহাস ও সমাজ-বাস্তবতা । এবং মিশন শুরুর আগেই নিজেকে সমাজের কাছে ‘কল্যাণকামী ও বিশ্বস্ত’ বলে প্রমাণ করতে হয় । দাওয়াত ও সংস্কারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করার একটা বড় কারণ গোমরাহ-বিভ্রান্তদের উপর দরদ ও ভালোবাসা । তারাও আমার ভাই ও বন্ধু-স্বজন । তাদের ক্ষতি, বিপর্যয় ও ধ্বংস হৃদয়ে রক্ত ঝরায় বলেই আমি তাদের কাছে মুক্তি ও সফলতার পয়গাম নিয়ে হাজির হই । তারা প্রত্যাখ্যান করলে তাদের ভবিষ্যত ভাবনা আমাকে ব্যথিত-শঙ্কিত করে তোলে । সকল নবী- রাসূল (আঃ) এর মনের অবস্থা এমনই ছিল । আমাদের নবীজির অন্তরের পেরেশানির চিত্র এঁকেছেন মহান আল্লাহ এভাবে, ‘তারা যদি এই বাণীর উপর ঈমান না আনে/মুমিন না হয় তবে তো আপনি তাদের জন্য পরিতাপ করতে করতে নিজেকেই নিঃশেষ করে ফেলবেন’ । (সূরা: [১৮] কাহফ, আয়াত: ৬; সূরা: [২৬] শুআরা, আয়াত: ৩ ।) আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রা. বলেন, যেন আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর দিকে তাকিয়ে আছি, তিনি একজন নবী (আঃ) এর কথা বর্ণনা করছেন- তাঁকে তাঁর কওম প্রহার করে রক্তাক্ত করেছে, তিনি আপন চেহারা থেকে সেই রক্ত মুছছেন আর বলছেন, হে আল্লাহ, আমার কওমকে ক্ষমা করুন, তারা তো অবুঝ । (সহীহ বুখারি, হাদীস নং-৩৪৭৭, ৬৯২৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৭৯২ ।)
এই নববি দরদ ছাড়া তাবলীগ ও তাজদীদের নামে চিৎকার-চেঁচামেচি, হুমকি-ধমকি ও হম্বিতম্বির কোনো অর্থ নেই । আপনি যদি তাকে ভালো না বাসেন, যদি কল্যাণ না চান, তবে কোন অর্থে তার কাছে দ্বীন পৌঁছাতে চাচ্ছেন, কেন তার ভুলের সংশোধন চাচ্ছেন ? আপনার শত্রু হলে ভুল পথে চলে সে ধ্বংস হোক- এটাই তো আপনার কামনা থাকবে ! আর ভালোবেসে কল্যাণ চাইলে, কথায় ও কর্মপদ্ধতিতে দরদের ছোঁয়া থাকবে । দরদহীন ধমকিবাজরা মূলত নিজের কর্ম সম্পর্কেই অসচেতন ।
বাজার থেকে সেরা জাতের বীজ এনে জমিতে ছিটিয়ে দিলেই তার অঙ্কুরোদ্গম হয় না, কাঙ্ক্ষিত মান ও পরিমাণের ফসল উঠে না । পর্যায়ক্রমে মেহনত করে জমিকে প্রস্তুত করতে হয়, বীজ বপনের জো বুঝতে হয়, জানতে হয় মাটির গুণাগুণ এবং কোন মাটি কোন ফসলের উপযুক্ত । মানব মনের যমিন বড়ই জটিল ও বৈচিত্রময়। মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব-প্রকৃতি ও আবেগ-অনুভূতি না বুঝে যখন তখন যেনতেনভাবে সত্যের বীজ ছিটিয়ে দিলে তা প্রত্যাখ্যাত হতে পারে । তখন এ কথা বলার কোনো সুযোগ নেই, ‘মানুষ সত্য কথা, তার রবের কথা কেন গ্রহণ করবে না’ !
দেখুন, মহান আল্লাহ মানুষের স্রষ্টা এবং মানুষ সৃষ্টিতে তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য তাঁর ইবাদত করা । কিন্তু সেই একমাত্র মাবুদ যখন মানুষের জন্য ইবাদতের বিধান নাযিল করেছেন, একবারেই নাযিল না করে দীর্ঘ সময় নিয়ে ধীরেধীরে ২৩ বছরে নাযিল করেছেন । মানুষের উপর চাপিয়ে দেন নি । কোনো কোনো বিধানকে তো চূড়ান্ত পর্যায়ে এনেছেন পর্যায়ক্রমে কয়েক বারে । মুফতি তাকি উসমানি বলেন, আরববাসী শতশত বছর থেকে মদপানে অভ্যস্ত ছিল । তাই আল্লাহ তাআলা তার নিষিদ্ধকরণে পর্যায়ক্রমিক পন্থা অবলম্বন করেছেন । প্রথমে সূরা নাহলে (১৬ : ৬৭) সূক্ষভাবে ইশারা করেছেন যে, নেশাকরা শরাব ভালো জিনিস নয় । তারপর সূরা বাকারায় (২ : ২১৯) কিছুটা পরিষ্কাভাবে বলে দিয়েছেন যে, মদপানের ফলে মানুষের দ্বারা এমন বহু কার্যকলাপ ঘটে যায়, যা কঠিন গুনাহ, যদিও তার মধ্যে কিছু উপকারিতাও আছে । তবে এর ভেতর বিভিন্ন রকমের গুনাহের সম্ভাবনা অনেক বেশি। তারপর সূরা নিসায় (৪ : ৪৩) আদেশ দেওয়া হয়েছে, তোমরা নেশার অবস্থায় সালাত আদায় করবে না । সবশেষে সূরা মায়িদায় (৫ : ৯০-৯১) মদকে অপবিত্র ও শয়তানি কর্ম সাব্যস্ত করতঃ পরিপূর্ণরূপে তা পরিহার করার দ্ব্যার্থহীন নির্দেশ দিয়ে দেওয়া হয়েছে । (মুফতি তাকি উসমানি, তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন ১/১৬১, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০১৬ খ্রি., মাকতাবাতুল আশরাফ, ঢাকা ।)
স্থান-কাল-পাত্রের ভেদে একই প্রশ্নের ভিন্নভিন্ন জবাব দিয়েছেন নবীজি (সাঃ)। ইসলামের কোন আমল উত্তম ?’ এ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হয়ে তিনি কাউকে জবাবে বলেছেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনা’ । কাউকে বলেছেন, ‘অল্প হলেও নিয়মিত আমল করা’ । কাউকে বলেছেন, ‘সময় মতো সালাত আদায় করা’ । কাউকে বলেছেন, ‘দীর্ঘ সালাত’। কাউকে বলেছেন, ‘উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ ও হাদঈ ও কুরবানির পশুর রক্ত ঝরানো’ । কাউকে বলেছেন, ‘খাবার খাওয়ানো এবং পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম দেওয়া’ ইত্যাদি ।’ (সহীহ বুখারি, হাদীস-১৫১৯; ৬৪৬৫; ৭৫৩৪; সুনান আবু দাউদ, হাদীস-১৩২৫; ১০ সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস-২৯২৪; মুসনাদ আহমাদ, হাদীস-৬৫৮১ ।)
দাওয়াতের আরেকটি নববি পদ্ধতি হল, বিশেষ প্রয়োজন না হলে মানুষের আবেগের স্থানে আঘাত না করা । আয়িশা রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট জিজ্ঞাসা করলাম, হাতীমের দেয়াল কি বাইতুল্লাহর অন্তর্ভুক্ত? তিনি বললেন, হ্যাঁ । আমি বললাম, তবে কেন তারা এটাকে বাইতুল্লাহর অন্তর্ভুক্ত করে নি ? তিনি বললেন, তোমার সম্প্রদায়ের নিকট পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এর দরজা উচুতে স্থাপিত হবার কারণ কী? তিনি বললেন, তোমার সম্প্রদায় তাদের ইচ্ছামতো কাউকে ঢুকতে দেবে আর কাউকে ঢুকতে দেবে না বলে এমনটি করেছে । তোমার সম্প্রদায়ের জাহিলিয়াত পরিত্যাগের যুগ যদি নিকটতম না হত এবং তাদের অন্তর পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা না করতাম তাহলে অবশ্যই আমি হাতীমের দেয়াল বাইতুল্লাহর অন্তভুক্ত করে দেওয়ার এবং তার দরজা সমতলে স্থাপন করার বিষয়ে বিবেচনা করতাম । (সহীহ মুসলিম, হাদীস-১৩৩৩ ।)
কিন্তু দাওয়াতের ক্ষেত্রে সাধারণত এসব সূক্ষ্ম বিষয় খেয়াল রাখা হয় না । আমরা ঈমানি জযবায় অপ্রস্তুত জমিতেই ‘হককথা’ বলার জিহাদে নেমে পড়ি । এবং তখন আমাদের দাওয়াত প্রত্যাখ্যাত হলে উম্মাতকে গালমন্দ ও দোষারোপ করেই নিজেদের কর্তব্য শেষ করি । তবে তার আগে নিজেকে ‘বিশ্বস্ত কল্যাণকামীরূপে’ প্রতিষ্ঠার এবং পর্যায়ক্রমিক মেহনতের মাধ্যমে মানুষের অন্তরকে সত্য গ্রহণের উপযুক্ত করে নেওয়ার দায় অনুভব করি না ।
আমরা আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহ. এর দাওয়াতি যিন্দেগির দিকে তাকালে দেখতে পাই, তিনি এক্ষেত্রে সুন্নাতুল্লাহ ও সুন্নাতুর রাসূলের পুরোপুরি আনুগত্য ও অনুসরণ করেছেন । এবং সে কারণেই তাঁর অল্প দিনের দাওয়াতই এমন ফলপ্রসু প্রমাণিত হয়েছে যা বহু লোকের সংগঠিত দীর্ঘদিনের দাওয়াতেও সাধারণত পরিলক্ষিত হয় না ।
মুসলিম জাতি আজ শতধা বিচ্ছিন্ন । মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো, পরস্পরে বিবাদে লিপ্ত হোয়ো না; তাতে তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রভাব নষ্ট হয়ে যাবে । আর ধৈর্য ধারণ করো, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন’ । (১১ সূরা: [৮] আনফাল, আয়াত: ৪৬ ।) আল্লাহর এ হেদায়াতে অবহেলা করে বর্তমানে আমরা কত দল- উপদলে যে বিভক্ত হয়েছি, তার শুমারও সম্ভব নয় ।
কিয়ামত পর্যন্ত সকল দেশ-কাল-ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠীর জন্য মনোনীত যে জীবনব্যবস্থা, তার উপযুক্ততা ও উপযোগিতার জন্য যেমন প্রয়োজন একমুখি ঋজুতা, তেমনি অনিবার্য হচ্ছে সরলতা- সহজতা এবং উদারতা ও প্রশস্ততা । স্বেচ্ছাচারিতা ও সঙ্কীর্ণতা যেমন সর্বকালীনতা ও সর্বজনীনতার জন্য বাধা তেমনি উদারতা ও প্রশস্ততা অপরিহার্য । মহান আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময় । তিনি তাঁর নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) এর মাধ্যমে যখন দ্বীনের পূর্ণতা ও সমাপ্তি টেনেছেন তখনই তার ভেতর পুরে দিয়েছেন এই উপযুক্ততা ও উপযোগিতা । আমরা বলি, উদারতা ও প্রশস্ততা প্রশংসনীয়, কিন্তু আমাদের অধিকাংশের হৃদয়ের যমিন খুবই সঙ্কীর্ণ । আমরা আমাদের হৃদয়ের সঙ্কীর্ণতা ও ক্ষুদ্রতার কারণে ইসলামের এই প্রশংসনীয় প্রশস্ততাকেও বানিয়েছি দলাদলি, হানাহানি, বিভেদ ও বিসম্বাদ চর্চার ক্ষেত্র ।
কিন্তু ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহ.র হৃদয় ছিল ইসলামের মতো বিশাল ও প্রশস্ত । তিনি সারা জীবন চেষ্টা করে গেছেন যেন উম্মাত ইসলামের প্রশস্ততাকে অন্তত ক্ষুদ্রতা চর্চার ক্ষেত্র না বানায় । তিনি তার লেখায়, কথায় ও কর্মে এই বার্তাটাই দেবার চেষ্টা করেছেন । যেসব বিধানের ক্ষেত্রে ইসলামে প্রশস্ততা রয়েছে, রয়েছে একাধিক পথ ও পদ্ধতির স্বীকৃতি সেসব স্থানগুলোকে যেন অন্যায় পক্ষপাতিত্বের মাধ্যমে সঙ্কীর্ণ করে ফেলা না হয় এবং তার কারণে আমরা দলাদলি, হানাহানি, বিভেদ ও বিসম্বাদে লিপ্ত না হই । তিনি উম্মাতকে বারবার অনুরোধ করেছেন, ইসলামের প্রশস্ততাকে প্রশস্ততার সাথে গ্রহণ করতে । এই প্রশস্ততা এমন ভিন্নতা নয় যে তাতে গন্তব্যই আলাদা হয়ে যায় । বরং একটি প্রশস্ত অঙ্গনের বিভিন্ন প্রান্তে বা পার্শ্বে অবস্থান করেও একটি আঙ্গিনার বাসিন্দা হওয়ারই মতো । একই কেউ গন্তব্যে একই রাস্তায় চলা; তবে কেউ হয়ত রাস্তায় ডানে চলছে, হয়ত বামে, আর কেউবা মাঝখানে । চলতে পথে হয়ত পাশ বদল করছে; পাশের জন মাঝখানে আসছে, মাঝখানের জন পাশে, কখনো বা ডানের জন বামে আর বামের জন ডানে । সকলেই পরস্পরের সহচর-সহযোগী; ভিন্ন পথযাত্রী বা প্রতিপক্ষ নয় । স্যার তার বিভিন্ন লেখায় ও বক্তৃতায় এসব কথা বিশদভাবে বলেছেন । তবে এক্ষেত্রে তার বিশেষ কাজ হচ্ছে ১. ‘সহীহ হাদীসের আলোকে সালাতুল ঈদের অতিরিক্ত তাকবীর’ এবং ২. ‘সালাতের মধ্যে হাত বাঁধার বিধান: একটি হাদীসতাত্ত্বিক পর্যালোচনা’ বই দুটি ।
এই দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মপদ্ধতির উপরও বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে । আমাদের সালাফদের রীতি ছিল, যে অঞ্চলে যে আমল প্রচলিত তা দলীলসিদ্ধ হলে আমল ও আম মানুষের কাছে দাওয়াত-প্রচারের ক্ষেত্রে তার উপরই সীমাবদ্ধ থাকা । কিন্তু আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহ. ইখতিলাফি বিষয়ে সকল মত ও তার দলীল উল্লেখ করেছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে কোনো একটা মতকে প্রাধান্য দেওয়া ছাড়াই তার আলোচনা শেষ করেছেন । এসব কিছু তিনি করেছেন সাধারণ মানুষের ভাষায়। এটা সালাফের রীতিবিরুদ্ধ । তাছাড়াও রয়েছে আরো দুটি সমস্যা । প্রথমত এতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয় । তারা বুঝে উঠতে পারেন না কোনটার উপর আমল করবেন । দ্বিতীয়ত মুজতাহিদগণ যখন কোনো একটি বিষয়ে ভিন্নভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হন তখন সর্বদা সবগুলো সিদ্ধান্তই সঠিক হওয়া অনিবার্য নয়, বরং কোনো কোনো সিদ্ধান্ত ভুলও হতে পারে, যেমন হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, নবীজি (সাঃ) বলেন, বিচারক যখন ইজতিহাদের সাহায্যে ফায়সালা প্রদান করেন এবং এক্ষেত্রে তিনি যদি সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হন তবে তার জন্য রয়েছে দুটি পুরস্কার । আর ইজতিহাদের মাধ্যমে ফায়সালা দিতে গিয়ে যদি তার ভুল হয়ে যায় তবে তার জন্য রয়েছে একটি পুরস্কার । (মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং-১৭৭৭৪, ১৭৮১৬, ১৭৮২০; সহীহ বুখারি, হাদীস নং- ৭৩৫২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৭১৬; সুনান আবু দাউদ, হাদীস নং-৩৫৭৪; সুনান তিরমিযি, হাদীস, হাদীস নং-১৩২৬; সুনান নাসায়ি, হাদীস নং-৫৩৮১; সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস নং-২৩১৪ ) । হাদীসটি আমর ইবনুল আস রা. ও আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত) সুতরাং সকল ইজতিহাদি মতের স্বীকৃতি দেওয়া মানে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুলেরও স্বীকৃতি দেওয়া ।
কিন্তু যেহেতু কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া যায় না, মহান আল্লাহ তা দেনও নি, তিনি বলেন, ‘আমি কারো উপর তার সাধ্যাতীত দায়িত্ব অর্পণ করি না’ (সূরা: [৬] আনআম, আয়াত: ১৫২; সূরা: [৭] আ’রাফ, আয়াত: ৪২; সূরা: [২৩] মু’মিনূন, আয়াত: ৬২) । এজন্য কোনো মুজতাহিদ যখন তার সাধ্যানুযায়ী পূর্ণ সততা ও যোগ্যতার সাথে বিশুদ্ধ পদ্ধতিতে ইজতিহাদ করে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হন তখন তিনি তার আমল ও দাওয়াতে সেটাই গ্রহণ করবেন । এক্ষেত্রে তার দৃষ্টিভঙ্গি হবে- আমার এ মতটি সঠিক, যদিও ভুলের আশঙ্কা মুক্ত নয়, আর এর বিপরীত মতটি ভুল, অবশ্য সেটি সঠিক হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে ।
তৎকালীন বিশ্বপরিস্থিতি, যোগাযোগব্যবস্থা ও ঘটনাপ্রবাহের স্বাভাবিক দাবি ও অনিবার্য পরিণতি ছিল অঞ্চলভিত্তিক ফিকহি মাযহাব চালু হওয়া। ইসলামের দায়ি ও মুবাল্লিগগণ বিভিন্ন অঞ্চলে দীনের দাওয়াত নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন । তাদের হাতে হাজার হাজার মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছেন । এবং প্রত্যেক অঞ্চলের সাধারণ মানুষ তাদের কাছে ইসলাম নিয়ে আসা দায়ি-মুবাল্লিগদের মাযহাব গ্রহণ করেছেন । এর বাইরের কোনো মতামত, মতাদর্শ ও মতাদর্শী সম্পর্কে জানার তেমন সুযোগও তাদের ছিল না । কিন্তু বর্তমানে বিশ্বপরিস্থিতি বদলে গেছে, পৃথিবী সঙ্কুচিত হয়ে এসে গেছে মানুষের হাতের মুঠোয় । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষকে করেছে প্রগতিশীল, জীবনে দিয়েছে গতি । এদেশের মুসলিম জনসাধারণ অন্যান্য মুসলিম জনপদসহ ইসলামের উৎসভূমি মক্কা-মদীনায় সফর করছে অহরহই । তারা হাতের মুঠোয় দেখতে পাচ্ছে কোন অঞ্চলের মুসলিমদের আমল কেমন, জানতে পারছে কোন অঞ্চলের আলিমদের ফতোয়া কী । এ পরিস্থিতিতে অন্যান্য সব বিষয়ের মতো ধর্মীয় এই বিষয়গুলোও আমাদের দেশে চলে এসেছে খুব স্বাভাবিকভাবে । এবং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় দুলে উঠেছে আমাদের সমাজ । জনসাধারণের মাঝে শুরু হয়েছে বাকবিতণ্ডা, বাদানুবাদ এবং চরম বিশৃঙ্খলা । সাধারণ মানুষের এ প্রতিক্রিয়ার কারণেই আমাদের সালাফগণ কোনো অঞ্চলে সে অঞ্চলের মানুষের কাছে অপরিচিত মতামত প্রচার করা অপছন্দ করতেন । কেননা আমাদের তো কর্তব্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (স) এর নিখুঁত আনুগত্য করা । কোনো এলাকার মানুষ কোনো একটা মাযহাবের অনুসরণের মাধ্যমে তা সুচারুরূপে সম্পাদন করলে সেখানে অন্য মতাদর্শ আমদানি করে সমাজে অহেতুক বিশৃঙ্খলা তৈরি করার কোনো অর্থ হয় না ।
কিন্তু সমাজে যখন একাধিক মতামত হাজির হয়ে যায় এবং সাধারণ জনগণ তার হাকীকত না বুঝে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে তখন কোনোটা ভুল হলে সেটা যেমন আলিমগণ সুস্পষ্ট জানাবেন, তেমনি সঠিক হলে সেগুলোর পক্ষেও সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করবেন । এটা কেবল সালাফের রীতিই নয় বরং স্বয়ং নবীজি (স) এর সুন্নাত । আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রা. বলেন, আমি একব্যক্তিকে একটি আয়াত তিলাওয়াত করতে শুনলাম, যেটি রাসূলুল্লাহ (স) কে আমি ভিন্নভাবে পড়তে শুনেছি । আমি লোকটিকে নিয়ে নবীজি (স) এর নিকট গিয়ে তাঁকে ঘটনাটি জানালাম । এবং এতে তাঁর চেহারায় অসন্তুষ্টি লক্ষ্য করলাম । তিনি বললেন, তোমরা উভয়েই সঠিক ও সুন্দর পড়েছে। তোমরা মতবিরোধ করবে না। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তীরা মতবিরোধের কারণেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে ।(সহীহ বুখারি, হাদীস নং-৩৪৭৬।) এ হাদীস থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, একাধিক বিশুদ্ধ মতের কোনো একটি নিয়ে প্রশ্ন উঠানোকেই রাসূলুল্লাহ (স) নিন্দনীয় ইখতিলাফ বলে আখ্যায়িত করেছেন । ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহ. তো রাসূলুল্লাহ (স) এর এ সুন্নাতের উপরই আমল করেছেন ।
একটি ফিকহি পরিমণ্ডলে অবস্থানকারী কোনো সাধারণের জন্য ভিন্ন মাযহাবের অনুসরণেও আপত্তি করেছেন আমাদের সালাফগণ। তারা তার কারণ হিসাবে বলেছেন, যথাযথভাবে কোনো মাযহাব অনুসরণের জন্য যে সকল উপকরণের প্রয়োজন তা সে পাবে না । কোনো জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হলে তার সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় কিতাবাদি যেমন পাবে না, তেমনি পাবে না সে মাযহাবের যোগ্য আলিমও । ফলে ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তিতে পতিত হবে । কিন্তু বর্তমান সময়ে এটা তেমন কোনো সমস্যা নয় । পৃথিবীর একপ্রান্তে বসবাসকারী অনুসারী অন্য প্রান্তের আলিমের কাছে যেমন বিভিন্ন মাধ্যমে তার জিজ্ঞাসা তুলে ধরে অতি অল্প সময়ে জবাব পেতে পারে, তেমনি অল্প আয়াসেই প্রয়োজনীয় কিতাবপত্রও সংগ্রহ করতে পারে । তবে এটা তো কখনো হয় না যে, কুরআন-সুন্নাহয় অজ্ঞ কোনো সাধারণ মানুষ তার এলাকায় অপরিচিত কোনো মাযহাবের অনুসরণ করছে । কেননা সাধারণত সাধারণ মানুষের মাযহাব হয়ে থাকে তার কাছে পরিচিত বা নির্ভরযোগ্য কোনো আলিমের মাযহাব ।
মুজতাহিদগণ যখন ইজতিহাদের মাধ্যমে একাধিক সিদ্ধান্তে উপনীত হন, আর আমরা নিশ্চিত জানি, এর একটি মাত্রই সঠিক, বাকিগুলো ভুল । কিন্তু দলীলের মাধ্যমে কোনটি সঠিক আর কোনটি ভুল তা চূড়ান্ত ও সুনিশ্চিত করা না যায়, তবে সে অবস্থায় সবগুলো মতের স্বীকৃতি তো সকল আলিমই দেন । যেমন ইবন তাইমিয়া রাহ. বলেছেন, আলিমগণ নবীদের (স) ওয়ারিস, শরীআতের বিধানের ক্ষেত্রে তাদের ইজতিহাদ ওই চার ব্যক্তির মতো, যারা অন্ধকার ও অপরিচিত স্থানে বিভিন্ন আলামত ও সূত্র ধরে কাবার দিক নির্ধারণ করল এবং প্রত্যেকেই ভিন্নভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হল । এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ অনুসারী নিয়ে নিজেদের ই’তিকাদ অনুযায়ী ‘এটা কাবার দিক’ মনে করে চারদল চারদিকে মুখ করে সালাত আদায় করল। এক্ষেত্রে চার দলের সালাতই সহীহ, যদিও একটি দলই প্রকৃতপক্ষে কাবার দিকে মুখ করে সালাত আদায় করেছে। (ইবন তাইমিয়া, মাজমুউল ফাতাওয়া ২০/২২৪ (শামিলা) ।
এক্ষেত্রে হাদীসের একটি ঘটনা লক্ষ্যণীয়। আওফ ইবন মালিক রা. বলেন, হুমাইর গোত্রের একব্যক্তি যুদ্ধে শত্রুপক্ষের একব্যক্তিকে হত্যা করল এবং তার যুদ্ধলব্ধ সম্পদ নিতে চাইল । কিন্তু সেনাপতি খালিদ রা. তাকে বাধা দিলেন । তখন আওফ ইবন মালিক রা. রাসূলুল্লাহ (স) এর নিকট এসে তাঁকে ঘটনা জানালেন । নবীজি খালিদ রা.কে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি তাকে কেন নিহত ব্যক্তির সম্পদ দিলে না? তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, তার সম্পদ ছিল প্রচুর । নবীজি (স) বললেন, তুমি তা তাকে দিয়ে দাও । খালিদ রা. নির্দেশ পালনের জন্য যখন আওফ রা. এর পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন তখন তিনি তাঁর চাদর টেনে ধরে বললেন, আমি যা বলেছিলাম তা কি আমি বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছি? রাসূলুল্লাহ (স) তাঁর একথা শুনে রাগান্বিত হলেন এবং নতুন নির্দেশ দিলেন, হে খালিদ, তুমি তাকে তা দিয়ো না । হে খালিদ, তুমি তাকে তা দিয়ো না ।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৭৫৩ ।)
উল্লিখিত হাদীসটি ইজতিহাদি ইখতিলাফের এক জটিল বয়ান । খালিদ রা. জানেন, যুদ্ধক্ষেত্রে নিহতের সম্পদ ঘাতক যোদ্ধারই হক । কিন্তু তিনি ইজতিহাদ করেছেন, এটি অল্প সম্পদের ক্ষেত্রে, অধিক সম্পদের ক্ষেত্রে নয় । তবে আওফ রা. এর ইজতিহাদি রায় ভিন্ন- কম হোক, বেশি হোক, ঘাতকই পাবেন নিহতের সম্পদ । সে কথা তিনি তৎক্ষণাৎ জানিয়েছেন খালিদ রা.কে । কিন্তু খালিদ রা. একমত হন নি । তাই তিনি তা নবী (স) কে জানান । তখন নবীজি (স) খালিদ রা.কে নিহতের সম্পদ ঘাতক যোদ্ধাকে দিয়ে দেবার আদেশ করেন। আমরা বুঝি, খালিদ রা. এর ইজতিহাদ ভুল ছিল। কিন্তু এই ইজতিহাদি বিচ্যুতির জন্য আওফ রা. যখন খালিদ রা.কে কটাক্ষ করেন । তখন নবীজি (স) শুধু অসন্তুষ্টিই প্রকাশ করেন নি, খালিদ রা. এর সেই রায় কার্যকর করে দেন আমরা যাকে ভুল মনে করেছিলাম ।
যেসব বিষয় নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়েছে এবং একপক্ষ অন্যপক্ষের দাবি অস্বীকার করার কারণেই বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে, তখন বিষয়টি যতই অ্যাকাডেমিক হোক, সাধারণ মানুষের কাছে তাদের ভাষায় বাস্তবতা তুলে ধরা ছাড়া তো আর কোনো বিকল্প থাকে না । বিষয়টি নিন্দনীয় তো তখন হবে, যখন একটি নিস্তরঙ্গ সমাজে অহেতুক অ্যাকাডেমিক বিতর্কিত বিষয় টেনে এনে ঝামেলা সৃষ্টি করা হয়।
সাধারণ মানুষের ভাষা বলতে আমরা কী বুঝি? কুরআন ও হাদীসেও এমন অসংখ্য বিষয় আছে যা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয় । মহান আল্লাহ নিজেই বলেছেন, ‘এইসব দৃষ্টান্ত আমি মানুষের জন্য উপস্থাপন করেছি, অথচ জ্ঞানীগণ ছাড়া তা অনুধাবন করতে পারে না’ ।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৭৫৩)। এই কুরআন ও হাদীসের ভাষা আরবি, যা কোটিকোটি সাধারণ মানুষের ভাষা । তাছাড়া এই চৌদ্দশত বছরে আমাদের উলামায়ে কিরাম বিশেষ ব্যক্তিবর্গের জন্যও যাকিছু রচনা করেছেন, সেগুলোও তো এমন ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন যা কোটিকোটি সাধারণ মানুষের ভাষা । এবং এসবের জন্য তো এমন ব্যবস্থাও তৈরি করা সম্ভব হয় নি যে, কিছুতেই যেন তা সাধারণ মানুষের হাতে না পৌঁছে । তবে এদেশের কিছু ধর্মপণ্ডিত সাধারণ মানুষের ভাষা বলতে শুধু বাংলাভাষাকেই বোঝেন ।
যারা মনে করেন, কুরআন ও সহীহ হাদীস মেনে চললে কোনো ধরনের ইখতিলাফই থাকবে না, তারা অভিযোগ করেন, স্যার একাধিক মত মেনে নিয়ে মূলত কুরআন-সুন্নাহর অবমাননা করেছেন এবং বিদআতকে সমর্থন করেছেন । তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলা নিষ্প্রয়োজন । তারা কুরআন ও সহীহ হাদীস মেনে সকল ইখতিলাফ তুলে দিতে গিয়ে নিজেদের মাঝে অসংখ্য নতুন ইখতিলাফের জন্ম দিয়েছেন ।
তাদের দাবির বিপরীতে স্যারের বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘যে সকল বিষয়ে সাহাবি-তাবিয়িগণের মতভেদ বিদ্যমান ছিল সে সকল ক্ষেত্রে মতভেদ বিদ্যমান থাকাই সুন্নাত ।… এ সকল বিষয়ে সাহাবি-তাবিয়ি ও প্রসিদ্ধ মুজতাহিদ ইমামগণ কোনো একটি মতকে উত্তম বলে গ্রহণ করেছেন, কিন্তু কখনোই ব্যতিক্রম মতকে বাতিল বলার বা ব্যতিক্রম মতের অনুসারীকে ‘বিভ্রান্ত’ বলে গণ্য করার চেষ্টা করেন নি । কাজেই এ জাতীয় মতভেদের ক্ষেত্রে সুন্নাতের নির্দেশনা মতভেদ মেনে নেওয়া, নিজের বা নির্ভরযোগ্য আলিমের ইজতিহাদকে উত্তম বলা এবং অন্য মতের সম্মান করা । সাহাবি- তাবিয়িগণের যুগের প্রমাণিত এ সকল বিষয়ের কারণে কাউকে ‘বাতিলপন্থী’ বলে গণ্য করা অথবা মতভেদ মিটিয়ে সকলকে একমত করাকে দ্বীন মনে করা বিদআত’ । (ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, রাহে বেলায়াত, পৃ। ২১, ষষ্ঠ সংস্করন ২০১৩ খ্রী, আস-সুন্নাহ পাব্লিকেশন্স, ঝিনাইদহ ।)
তবে তাঁর পাঠক-শ্রোতার কাছে একথা অস্পষ্ট নয় যে, তিনি কখনো শিরক-বিদআতের বিষয়ে নমনীয়তা দেখান নি এবং বে-দলীল মতভেদেরও কোনো স্বীকৃতি দেন নি ।