বাংলায় জাতবৈষম্য সেন-আমলে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিল। সেনরাজাদের আদি বাসস্থান ছিল কর্ণাটকের মহীশুর এবং তার সংলগ্ন অঞ্চলে । বীর সেনকে সেনবংশের আদিপুরুষ বলে ধরা হয়। সেনরা কখন বাংলায় এসেছিলেন তার সঠিক তথ্য ঐতিহাসিকদের হাতে নেই । তবে এটা ঠিক যে সামন্ত সেনই প্রথম বাংলায় বসবাস করা শুরু করেছিলেন।
পালরাজাদের পরাজিত করে সেনরাজবংশের পত্তন হয় বাংলায়। সেনবংশীয় রাজাদের মধ্যে বীর সেন, সামন্ত সেন, হেমন্ত সেন, বিজয় সেন, সুখ সেন, বল্লাল সেন ও লক্ষণ সেন বিশিষ্ট ছিলেন।
সেনবংশের রাজারা বিশেষ করে বল্লাল সেন ও লক্ষণ সেন ব্রাহ্মণদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং ব্রাহ্মণ্যবাদিতার উৎ্কট সমর্থক ছিলেন। এঁদের হাত দিয়েই বাংলায় বর্ণবৈষম্যের কদাচারিতা চরম প্রকটতা লাভ করে। মূলত বল্লাল সেনই জাতপাত, স্পৃশ্যাস্পৃশ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলার মানুষদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলেন। এবং এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে বাংলার সাধারণ মানুষদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব নষ্ট করেছেন তিনি, সমাজের মধ্যে মানুষে মানুষে বিভাজন ঘটিয়ে নিজের আখের গুছিয়েছেন। এতে বল্লাল সেনের সাময়িক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লাভ হলেও শেষপর্যন্ত কিন্ত সর্বনাশ হয়ে গেছে বাংলার আপামর জনগণের ৷ জাতপাত শ্রেণিবৈষম্যের খপ্পরে পড়ে বাংলার সমাজব্যবস্থায় ধস নেমেছে, মানুষে মানুষে হিংসা বেড়েছে, সৌভ্রাতৃত্ব নষ্ট হয়েছে, সর্বোপরি লাঞ্ছিত হয়েছে মানবতা ।
দ্বাদশ শতকের শেষদিকে সেনবংশের লোকদের মধ্য থেকে সামান্যতম মনুষ্যত্ববোধেরও অবলুপ্তি ঘটেছিল । সেনরাজা, রাজপুরুষ, রাজকর্মচারী এবং অন্য আধিকারিকরা ভীষণ রকম দুর্ণীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। অনাচার ব্যভিচার-কুসংস্কারে একেবারে নিমজ্জিত হযে গিয়েছিলেন তাঁরা। ঐশবর্য বিলাস, কামচারিতা, শৃঙ্গারাবিষ্টতা, তাঁদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল । ওখানেই থেমে থাকেননি সেনরাজা এবং তাঁদের কর্মচারী-কর্মকর্তারা। বাংলার সমাজ কাঠামোর দিকেও কুনজর দিয়েছিলেন। তাঁরা জাতপাতের বৈষম্যকে প্রকট করে তুলেছিলেন।
স্পৃশ্যাস্পৃশ্যের বিষয়টাকে বল্লাল সেন এমন একটা অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, যাতে পিষ্ট ও অতিষ্ট হয়ে শূদ্ররা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা শুরু করেছিল। এই সময় ব্রাহ্মণ ও সেনরাজন্যদের অত্যাচারে নিম্ন বর্ণের মানুষেরা তাদের ধন সম্পদ এবং নারীর নিরাপত্তা বিধানে অসহায় হয়ে পড়েছিল।
সেনরাজারা ছিলেন ব্রাক্ষণ্যবাদী এবং গোঁড়া। রক্ষণশীলতার ছত্রছায়ায় সেনরাজা ও রাজপুরুষেরা প্রজাসাধারণকে নির্মম শোষণ ও নিষ্ঠুর নির্যাতন করত।
সমাজ দুই কোটিতে বিভক্ত ছিল – উচ্চকোটি এবং নিম্নকোটি । সেনবংশীয় শ্রেণিব্যবস্থা ও শোষণ প্রক্রিয়ার কারণে এই উচ্চকোটি তথা উচুজাতের মানুষেরা লাভবান হতো খুব। ক্ষতিগ্রস্ত হতো নিম্নকোটি তথা নিচুজাতের মানুষেরা । উচ্চশ্রেণির মানুষদের সংখ্যা ছিল অকিঞ্চিৎকর। নিম্নশ্রেণির মানুষরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ । সংখ্যায় তাঁরা পঁচাশি শতাংশের অধিক ছিল । এই পঁচাশি শতাংশ নিম্নজাতের মানুষ ছিল দরিদ্র, অবহেলিত, অপাংক্তেয়। দ্বাদশ শতকে এই নিচুজাতের মানুষেরা কী পরিমাণ দুর্বিষহ জীবনযাপন করত, তা চর্যাগীতিতে স্পষ্ট হয়ে আছে। ঢেণ্ঢনপা লিখেছেন –
টালত মোর ঘর নাহি পড়িবেশী ।
হাঁড়ীতে ভাত নাহি নিতি আবেশী ।।
বেঙ্গ (ণ) সংসার বড়হিল জাঅ ।
দুহিল দুধু কি বেন্টে সমাঅ ।।
বঙ্গানুবাদ : টিলাতে আমার ঘর । প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতে ভাত নেই । নিত্যই ক্ষুধিত। ব্যাঙের সংসার বেড়ে চলেছে। দুহিত দুধ আবার বাঁটে ঢুকে যাচ্ছে।
বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষগুলো, যাদের অধিকাংশই নিম্নশ্রেণির ছিল, প্রায় অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছিল। নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত তারা, রোগ-মুক্তির পথ অজানা। নৈরাশ্য আর অসহায়তা তাদের ঘিরেবেড়ে আছে। ঠিক এই সময়ে গোপাল দেবের আবির্ভাব । মাৎস্যন্যায়ের অবসান ঘটিয়ে ধর্ম-বর্ণ-জাত-শ্রেণি-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাংলার মানুষেরা গোপালদেবকে স্বাগত জানিয়েছিল। কারণ তারা তখন বাংলা থেকে মাতস্যন্যায়ের অবসান ঘটাতে চাইছিল । গোপালদেব বাংলায় গৌরবজনক অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন।
কিন্তু ত্রয়োদশ শতকের গোড়ার দিকে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি যখন বাংলার পশ্চিম ও উত্তরাংশে আক্রমণ চালালেন, তখন তাঁকে প্রতিহত করবার মতো কোনো রাজা-রাজন্য-সেনাপতিকে পাওয়া গেল না। ফলে খুব সহজেই মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল ওখানে । লক্ষণ সেন পালিয়ে এলেন নবদ্বীপ নদীয়ায়। পশ্চিমবাংলা থেকে উৎখাত হয়ে পূর্ব বাংলায় আশ্রয় নিয়েছিলেন লক্ষণ সেন।
পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলা দখল করার পর খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকের গোড়ার দিকে মুসলমানরা সমগ্র বাংলাকে মুসলমানের দেশ হিসেবে ঘোষণা করল। কোন কোন ঐতিহাসিক দাবি করেন, বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর মুসলমান শাসকেরা এদেশের অমুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে নিয়েছিল । এবং ওই সময় হিন্দুরা ভূমিদাস বা ক্রীতদাসে অবনমিত হয়েছিল। এই দাবি সর্বাংশে সঠিক নয়। কিছু কিছু এঁতিহাসিক দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, মুসলিম বিজেতারা হিন্দু জনসমষ্টিকে রাজনৈতিক-অধিকার বঞ্চিত করলেও হিন্দুদের জাত-বর্ণ ব্যবস্থাকে কোন ভাবেই প্রশ্রয় দেয়নি। প্রশ্রয় তো দূরের কথা অধিকন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদি বর্ণ বৈষম্যের বিরোধিতা করেছিল মুসলিম শাসকেরা। মুসলিম শাসক শ্রেণীর হিন্দুর জাত-বর্ণ-বিরোধি অবস্থানের ফলে বাংলায় কট্টর বর্ণব্যবস্থা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়েছিল।
বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর ইসলাম ধর্ম প্রচারকেরা শাসকের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় একের পর এক অসহায় দরিদ্র হিন্দু আর বৌদ্ধকে প্রাণের ভয় দেখিয়ে, বৈষয়িক সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে মুসলমান বানাতে আরম্ভ করল । যারা ভীত হয়নি বা প্রলুব্ধ হয়নি, তাদের হত্যা করা হয়েছে, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের, ধনসম্পত্তি লুষ্ঠন করা হয়েছে- এরকম দাবি করেছেন অনেক এঁতিহাসিক। কিন্তু কথাটা যদি আদৌ সত্যি হতো, তাহলে বর্তমানে বাংলাদেশে বা পশ্চিমবঙ্গে একজনও হিন্দু থাকত না। কিন্তু একথা অস্বীকার করার নয় যে, সেই সময় এদেশের কোনো হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি । করেছিল দুটো কারণে (পরে) । একটা হলো বৈষয়িক কারণ । ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর শাসকদের কাছ থেকে অনেক বেশি অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাবে, এই লোভে অনেক হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল । দ্বিতীয় কারণ হলো- জাতপাত ও বর্ণবৈষম্যের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে নিম্নবর্ণের অনেক হিন্দুর প্রাণ তখন ওষ্ঠাগত। একে তো তারা খেতে পাচ্ছিল না, তার ওপর জাতবর্ণের শোষণ । এই দুইয়ের চাপে নিচুজাতের হিন্দুরা তখন দিশেহারা । তখন তারা ভেবেছে, সাম্যবাদী ইসলাম ধর্মে আশ্রয় নিলে তাদের জীবন বাঁচবে, বর্ণবাদী স্টিমরোলারের পেষণ থেকে মুক্তি পাবে। তাই দলে দলে নিম্নবর্ণের মানুষেরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে।
ওই সময় হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার সংস্কারকেরা বুঝেছিলেন, হিন্দুদের এই ধর্মান্তর বন্ধ করতে না পারলে অবিলম্বে বাংলা থেকে হিন্দু ধর্মটাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে । তাঁরা এ-ও অনুধাবন করলেন যে, নিম্নজাত নিম্নশ্রেণির মানুষদের হিন্দু ধর্মে অবিচল রাখতে পারলে বন্যার জলের মত ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রবণতা অনেকাংশে কমে আসবে। তাঁরা বুঝেছিলেন, উঁচু বর্ণের হিন্দুদের বর্বরোচিত শোষণ ও নির্যাতনের ফলেই অনেকানেক শূদ্রশ্রেণির হিন্দুরা মসলমান হয়েছে। সমাজ সংস্কারকেরা আরো উপলব্ধি করেছিলেন, ধর্মান্তরের ব্যাপারটা রুখে দিতে চাইলে প্রথমেই নিজেদের মধ্যে মানবতার উদবোধন ঘটাতে হবে। বর্ণবাদী হিন্দুদের গোঁড়া-মনস্কতার রূপান্তর ঘটাতে হবে। অর্থাৎ জাত-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মধ্যে মানুষ সম্পর্কিত ধ্যানধারণাকে শুভতার দিকে ধাবিত করতে হবে। নিম্নশ্রেণির মানুষেরাও যে মানুষ, সেটা প্রকাশ্যে মেনে নিতে হবে। চন্ডীদাসের এই কথাটি মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করলেন সমাজসংস্কারকেরা –
শোন হে মানুষ ভাই,
সবার উপরে মানুষ সত্য
তাহার উপরে নাই।
বাংলায় আবির্ভূত হলেন মহাপ্রভু শ্রীচেতন্য। বর্ণবাদী ব্রাহ্মণের মুখের দিকে একদলা থুতু ছিটিয়ে তিনি ঘোষণা করলেন –
চণ্ডালোহপি দ্বিজশ্রেষ্ঠঃ
হরিভক্তি পরায়ণঃ।
অর্থাৎ ঈশ্বরপ্রবণ চণ্ডালও ব্রাহ্মণদের চেয়ে উত্তম। শ্রীচৈতন্য বৈষ্ণবধর্মের প্রবর্তন করলেন। দ্বিজ-চন্ডাল সবাই মানুষ, সবাই সমান । ব্রাহ্মণ বলে শ্রেষ্ঠ, শূদ্র বলে অধম । শূদ্ররা উঁচুবর্ণের লোকেদের সেবা করবে। এসব কথা সত্য নয়, গ্রহণযোগ্য নয় । এটাই বৈষ্ণবধর্মের মূল কথা। বর্ণেতর মানুষদের নিজবুকে ঠাই দিলেন শ্রীচৈতন্য । বললেন, ‘মেরেছিস কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দেবনা ?’ শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবে বাংলার সমাজ এবং ধর্মব্যবস্থা বিরাট একটা নাড়া খেল। এই নবধর্মের কারণে বাংলায় নতুন এক সমাজের পত্তন হলো । এই সমাজের নাম বৈষ্ণবসমাজ ৷ একটা নতুন জাতের পত্তন হলো, যার নাম বৈষ্ণবজাত।
পাল ও সেন যুগে শূদ্ররা বহুলভাবে লাঞ্ছিত এবং বঞ্চিত হয়েছে । জাত-বর্ণ প্রথার সুযোগ নিয়ে উচ্চতর তিন বর্ণের মাননুষেরা শূদ্রদের অবিরত শোষণ করে গেছে। কাজ করিয়ে কোন পারিশ্রমিক দেয়নি। উপরন্তু শূদ্রদের উৎপাদিত দ্রব্য আত্মসাৎ করেছে ।
মুসলমান রাজত্বের সময় মুসলমান শাসকশ্রেণির কাছ থেকে শূদ্ররা এরকম আচরণ পায়নি। পরিশ্রমের যথাযথ পারিশ্রমিক পেয়েছে তারা, কখনো মুসলমানরা তাদের উৎপাদিত দ্রব্য আত্মসাৎ করেনি। বর্ণগত নীচতার দোহাই দিয়ে মুসলমান সমাজ কখনো নিষ্পেষণ করেনি শূদ্রদের। মুসলমান যুগে শূদ্ররা বুকের মধ্যে প্রাণ খুলে বাতাস টেনে নিতে পারল। তবে তারা যে মুসলমান দ্বারা একেবারেই লাঞ্চিত বা শোষিত হয়নি, এমন নয়। ওগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা, ধারাবাহিক কোনো প্রক্রিয়া নয়। দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলা যেতে পারে, মুসলমান যুগে শূদ্ররা হিন্দু-বৌদ্ধ শাসনামলের তুলনায় অনেক বেশি স্বস্তিতে ছিল । কথায় আছে যেখানে ভাত, সেখানে জাত । শতসহস্র বছর ধরে লাঞ্চিত অবহেলিত অস্পৃশ্য শূদ্ররা তাই ইসলাম ধর্মের ছত্রছায়ায় জীবনের মাহাত্ম্য খুঁজে পেল। শূদ্রদের যারা ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত করেছে, তাদের প্রায় সবাই বহিরাগত। বিদেশাগত পীর, ফকির, সুফি, দরবেশরাই এদেশের মানুষদের মুসলমান বানিয়েছে। এই আগত পীর-ফকিররা প্রথমে এদেশে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে, তারপর নবদীক্ষিত মুসলমানদের স্বস্তি ও সুখে রাখার দায়িত্ব নিয়েছে। কোনোভাবে এই নও-মুসলমানরা বর্ণহিন্দু বা শাসক মুসলমানদের কারো দ্বারা অহেতুক লাঞ্ছিত বা শোষিত হলে এসব পীর ফকির দরবেশরা বাধা দিত। এতে নিম্নজাত হিন্দুরা চমৎকৃত হতো। এরকম আশ্রয়স্থল তো তাঁরা আগে কখনো খুঁজে পায়নি ! ফলে শূদ্রজাতের মানুষেরা আরও বেশি করে দরবেশ ফকিরদের দিকে ঝুঁকে পড়ল এবং ইসলামকে নিজেদের ধর্ম হিসেবে বেছে নিতে লাগল।
মুসলমানরা কখনো জাতপাতের শিকার হয়না, বর্ণ বৈষম্যের দোহাই দিয়ে কেউ তাদের শোষণ নির্যাতন করেনা। ইসলাম ধর্মে কোন জাত নেই, বর্ণ বৈষম্যের জাঁতাকল নেই। ইসলাম ধর্ম প্রচারকেরা বারবার এদেশের মানুষের কাছে এই কথাগুলো বলে গেছে। এই বলার মধ্যে কোন অসত্যতা নেই, নেই কোণ প্রতারণা।
প্রকৃত পক্ষে ইসলাম ধর্ম জাত বর্ণ ব্যবস্থাকে কোনভাবেই প্রশ্রয় দেয়না। ইসলাম ধর্ম মানবতা বিরোধি বর্ণবাদি এই জাতপাত ব্যবস্থাকে ঘৃণা করে। মূলত এরই টানে দলে দলে হিন্দুরা মুসলমান হয়েছে।
ধর্মান্তরিত হওয়ার পর তাদের সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটেছে। বিয়ে এবং অন্যান্য সামাজিক কাজকর্মে অনেক রূপান্তর এসেছে। নামেও পরিবর্তন এসেছে তাদের। পূর্বের হিন্দু নাম, মানে বাংলা নামের পরিবর্তে মুসলমানি নাম, মানে আরবি-ফারসি নাম গ্রহণ করেছে তাঁরা। নটবর শীল হয়েছে মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল। কিন্তু পরিবর্তন ঘটেনি তাদের বৃত্তিতে। ধর্মান্তরের আগে ওরা যে যে পেশা অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করত, ধর্মান্তরের পরেও তাদের সেই বৃত্তি থেকে গেল। বৃত্তি ঠিক থাকলেও বৃত্তির নামের পরিবর্তন হলো। বাংলা বৃত্তি নাম আরবি-ফারসি-তুর্কি নামে রূপান্তরিত হলো। বৃত্তি নামের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জাত নামেরও পরিবর্তন হলো। উদাহরণ হিসেবে একটা ছক এখানে সন্নিবেশ করা যায়।
বাংলা বৃত্তিনাম রূপান্তরিত – আরবি-ফারসি-তুর্কি নাম
পালকিবাহক – বেহারা
ধাত্রী – দাই
সূচীজীবী – দর্জি
সেলাইজীবী – খলিফা
নাপিত – হাজ্জাম
যুগী – জোলা
মাংস বিক্রেতা – কসাই
ফলবিক্রেতা – কুজড়া
তাঁতি – মোমিন
ধনুরী – মনসুরি
জেলে – নিকারি
বাদক – দফালি
চামড়ার বাদ্য যন্ত্র নির্মাতা – নট
মিষ্টান্ন নির্মাতা – হালুইকর
কর্মকার – কামার
মাঝি – মাল্লা
ছুতর – খরাদি
চিত্রকর – পটুয়া
ঝাড়ুদার – ভাঙ্গি
জুতা নির্মাতা – মুচি
গোয়ালা – গুজর
মেথর – লালবেগি
মুসলমান সমাজব্যবস্থাতেও দুটো বিভাজন লক্ষ করা যায় -আশরাফ আর আতরাফ। আশরাফ মানে ধনশালী, ক্ষমতাবান মুসলমান । আর আতরাফ মানে দরিদ্র, ক্ষমতাবিন্দু থেকে দূরে অবস্থিত মুসলমানসমাজ । উভয় শ্রেণির মধ্যে অলিখিত একটা পার্থক্য বিদ্যমান থাকলেও সেটা কখনো ব্রাক্ষণ্যবাদীদের শ্রেণীবৈষম্যের মতো প্রকট হয়ে ওঠেনি । যা কিছু পার্থক্য দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়েছে, তা শুধু সম্পদ ও ক্ষমতার নিরিখে, ধর্মের মধ্যে শ্রেণীবৈষম্যের কারণে নয় ।
যা হোক, বাংলায় সব সময় বহিরাগত আক্রমণকারীদের কারণে নানা ধর্মের আগমন ঘটেছে। আর্যদের সঙ্গে এসেছে মনু নির্ধারিত শ্রেণীবিভক্ত সনাতন ধর্ম, মুসলমানদের সঙ্গে এসেছে ইসলাম ধর্ম। পরবর্তীকালে ইংরেজ-ফরাসী-ওলন্দাজদের সঙ্গে এসেছিল খ্রীস্টধর্ম। শেষোক্ত দুই ধর্মের প্রভাবে বাংলায় দুটি নতুন জাতের পত্তন হয়ে হয়েছে। একটা মুসলমান জাত, অন্যটা খ্রিস্টানজাত।