খেলিছ এ বিশ্বলয়ে
বিরাট শিশু আনমনে,
প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা
নিরজনে প্রভু নিরজনে ||
এই গান মা গুনগুন করে গাইতেন । আর আনমনে কাজ করতেন। বাড়িতে বিদ্যুৎ চলে গেলে মা-চাচিরা গানের আসর বসাতেন। আর আমি হারিকেন সামনে স্কুলে পড়ায় ফাঁকি দিয়ে জানালা গলে মুখ বের করে ওই গান শুনতাম । তার মধ্যে অনেক গান আমার হৃদয়ে সুরের কান তৈরি করে দিয়েছিল । ‘আমি চির তরে দূরে চলে যাবো, তবুও আমারে দেবো না ভুলিতে’ এই গান গাইতে গাইতে মায়ের চোখ দিয়ে প্রায়ই পানি পড়ত । আমি অবাক হয়ে ভাবতাম মা কেন গান গাইতে গিয়ে কাঁদে । ‘লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া মজনু গো আখি খোলো, প্রিয়তম ! এতদিনে বিরহের নিশি বুঝি ভোর হলো ।’ এই গান মা চোখবুজে মুগ্ধ হয়ে গাইতেন। আর আপু নাচত এইসব গানে ‘দূর দ্বীপ-বাসিনী আমি তোমারে চিনি গো চিনি’ ‘মোমের পুতুল মমীর দেশের মেয়ে নেচে যায়। বিহ্বল চঞ্চল পায়। খর্জুর-বীথির ধারে । সাহারা মরুর পারে । বাজায় ঘুঙুর ঝুমুর ঝুমুর মধুর ঝঙ্কারে ৷’ আমিও দুলে দুলে সেসব মুদ্রা শিখতাম। গানগুলো যেন ছেলেবেলায় সুরের মোহনায় ভাসিয়ে নিত। তখনও বুঝি না কোনটা নজরুলসংগীত আর কোনটা রবীন্দ্রসংগীত । অনেক
বড় হয়ে জানতে পেরেছি প্রথম গানটি নজরুলের । আর বিস্ময়ে হতবাক হয়েছি, নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য । আমি ভেবেছিলাম এটা বুঝি রবীন্দ্রসংগীত। এভাবে রবীন্দ্র-নজরুলের ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠা হলেও নজরুল যেন ক্রমশ দূরে সরে যেতে লাগলেন, নানা কর্মব্যস্ততায় মা যেভাবে ধীরে ধীরে চোখের আড়াল হতে লাগলেন । তাই বলে কি মা সরে গেছে? আসলেই কি নজরুল সরে গেছেন আমার চিন্তার খোরাকে-মনের খোরাকে? আমার চেতনা তৈরিতে নজরুল কি কম ভূমিকা রেখেছিলেন? আজ বড় সাহস করে নজরুল নিয়ে লিখতে বসেছি, সাহস নয় দুঃসাহস। কারণ আমি কতটুকু জানি তাকে!
নজরুল থেকে নজরুলসংগীত । নজরুল শব্দটি বা নামটি যখন মনে পড়ে তখন চোখের কোণে ভেসে ওঠে নানান কিছু নজরুল ঘিরে । প্রথমে মায়ের কাছ থেকে জানা, তারপর বই পড়ে জানা। গ্রাম কুঁড়েঘর মেঠোপথ ক্ষেত ফসলাদি ধুলোমাখা জামা-কাপড়, যুদ্ধ-স্বাধীনতার শানিত শব্দের তুবড়ি ঝাড়োবৈশাখী দখিন হাওয়ায় বাসন্তীর মিশ্র প্রকাশ । নজরুলসংগীতে যেন আলো হাওয়া সব মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে সংগীতের নানান সুর-বাণী । পল্লীগীতি থেকে শুরু করে লোকগীতি, ভাটিয়ালি, বাউল, ভাওয়াইয়া, ঝুমুর, সাওতালী, কাজরী কী নেই তার গানে । হাসির গান, কমিক, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, গজল । স্কুলে প্রথম প্রতিযোগিতায় নজরুলের গজল গেয়েছিলাম হাঁটু কাঁপিয়ে । গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত প্রকৃতির সঙ্গে হিন্দিগান, ঠুমরি, কাওয়ালি, খেয়াল/উচ্চাঙ্গ, রাগ-প্রধান, দাদরা, টপপা, ধ্রুপদ সংগীত । আরও দেশাত্মবোধক, জাতীয় সংগীত, মার্চ বা রণসংগীত, স্বদেশি, নানা সংগীত, জাগরণী, উদ্দীপনা, আগমনী । পাই শিশু ছড়া আশীর্বাদ । ইসলামী কাওয়ালি, শব-ই-কদর, মহররম মর্সিয়া, শব-ই-বরাত, রামাদান, হামদ-নাত, শ্যামাসংগীত, দুর্গা-পূজা, হোরি/হোলি, ভজন/রাজভজন, ভক্তিগীতি, কীর্তন হরি-কীর্তন, রাধা-কৃষ্ণ, শিব/মহাদেব/নটরাজ, সাধন সংগীত, সরস্বতী, ঝুলন, লক্ষ্মী, সন্বর্ধনা, কাব্যগীতি, পালাগান (লেটো) প্রায় ৮০ ধরনের গানের সমাহার । সুরের নতুন মোড়কে মোড়কে গানের নতুন প্লাবন-মহাপ্লাবন ধারা । অর্থাৎ এটি একটি ইন্ডাস্ট্রি বা সংগীত কারখানা । কারখানায় সাধারণত মেইন প্রোডাক্ট হবার পর ওয়েস্টেজ দিয়েও হয় কিছু উৎপাদনসামগ্রী। নজরুলসংগীত ইন্ডাস্ট্রি থেকেও মেইন সংগীত সুর থেকে ভেঙে নানান সুর ধারার মিশ্রণ সংগীত সৃষ্টি হয়েছে । তাতে আশিটি প্রধান বিষয় থেকে ভেঙে নানান ধারার সুর মিশ্রকার গান। নজরুলসংগীত ইন্ডাস্ট্রিজের ভিতও পাকাপোক্ত, কারণ তৈরি হয় রাগ-রাগিণীর মিশ্রণে ।
আবার বাণীতে রয়েছে বৈচিত্রীয় শব্দ সংযোজন- যেমন : ‘চাঁদের পিয়ালাতে আজি জ্যোছনা শিরাজী ঝরে/ঝিমায় নেশায় নিশিথিনী যে শারক পান করে’ । কিংবা ‘কাল-বোশেখী মিছেই কাঁদে ফাগুন রাতের আফসোসে’ কিংবা ‘আলগা কর গো খোপার বাঁধন, দিল ওহি মেরা ফস গয়ি’ কিংবা ‘বৈকালী সুরে গাও চৈতালী গান, বসন্ত হয় অবসান । নহবতে বাজে সকরুণ মুলতান’ কিংবা ‘কাজরি গাহিয়া এসো গো ললনা’ কিংবা ‘হায় সাকি এ আঙ্গুরী খুন নয় ও হিয়ার খুন খারাব’ কিংবা হেরা হতে হেলে দুলে, নূরানী তনু ও কে আসে, হায়!/সারা দুনিয়ার হেরেমের পর্দা, খুলে খুলে যায়’ কিংবা ‘সৃজন ছন্দে আনন্দে নাচো নটরাজ/হে মহাকাশ প্রলয়-তাল ভোলো ভোলো’ কিংবা ‘আমি কালী যদি পেতাম কালি রইত না এ মনের কালী’–এই নজরুলসংগীত কারখানা বা শিল্প মেনিকোস্টো নতুন ঢঙে মোড়া । যেমন সংগীতে গায়কী, শিল্পী স্বাধীনতা এবং বৈঠকীর মিশ্রণ ৷ এর ব্যবহারও নজরুল করে গেছেন বিশ্লেষণে । আধুনিক বাংলা গানের পঞ্চ প্রধান ব্যক্তিতৃ হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১- ১৯৪১), দ্বিজেন্দ্রলাল (১৮৬৩-১৯১৩), রজনীকান্ত (১৮৬৫-১৯১০), অতুলপ্রসাদ (১৮৭১-
১৯৩৪) এবং কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। বিশ শতকের প্রথম চার দশকের মধ্যে এ পঞ্চরত্ন আধুনিক বাংলা গানকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন। বিশেষত রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের অবদান গুরুত্বপূর্ণ: তারা ছিলেন একাধারে কবি ও সংগীতজ্ঞ।
আধুনিক গানেরও প্রবর্তক ছিলেন নজরুল । নজরুলই প্রথম আধুনিক বা মডার্ন শব্দ দুটির প্রচলন, ব্যবহার তার সংগীত হেডিংয়ে যুক্ত করেন। ইনিয়ে বিনিয়ে সবার গানেই ‘আধুনিক’ সুর প্রবর্তনের সঙ্গে সুরের অবাধ বিচরণ আছে, অথচ নজরুলের সুরে আধুনিকতার এত এত প্রাণবন্ততা, যা অন্যতে পাওয়া একদমই দুষ্কর ৷
নজরুল-পূর্বে সকল গানই ছিল নায়কী প্রধান । নজরুল প্রথম যুক্ত করলেন সংগীতে গায়কী বিষয়টি ৷ নজরুল-পূর্বে যারা সংগীতে ছিলেন–রজনীকান্ত সেন, অতুল প্রসাদ সেন, দিজেন্দ্র লাল রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সকলেই নায়কীতে গান বাধতেন। অর্থাৎ ওরা যেমন সুর করেছেন শিল্পীকে হুবহু তেমনি গাইতে হবে, সুরের বা পর্দার কোনো হেরফের করা যাবে না। নজরুল এর থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে এলেন । তিনি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির পার্থক্যের
স্থান রাখলেন । যেমন একই রকম ব্যথার প্রকাশ ব্যক্তি বিশেষে একই রকম হবে এটা না করে ব্যক্তি বিশেষে ব্যথা-বেদনার প্রকাশ আলাদা হবে। এরকম হওয়াই তো স্বাভাবিক। গায়কীর যুক্ততায় শিল্পীরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন। তারা তাদের কণ্ঠকে কিছুটা নিজ গুণে ব্যবহার করতে শুরু করল । সংগীতে প্রাণের সৃষ্টি হলো । এখানে সামান্য বলা প্রয়োজন, বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোতে যারা উপস্থাপনা করেন তারা যে ধরনের ব্যাখ্যা এই ‘গায়কী’ নিয়ে বলে থাকেন, তা ঠিক নয়। তারা ব্যাক্তি-পার্থককে গায়কী ভেবেছেন। কিন্তু ব্যাপারটি তা নয়। ব্যাপারটি হবে সুরকার যে সুরটি করেছেন শিল্পী ঠিক
সে রকমটি না করে কণ্ঠ ব্যবধানে সুরের পর্দায় আলাদা ব্যবহার করে নিতেই পারেন। যা নায়কী প্রধান সঙ্গীতে ব্যক্তি বা শিল্পী ব্যবধানে সুর প্রকাশে তার পার্থক্য হয় না, শিল্পী পার্থক্যে সুর পার্থক্য শ্রুতিতে মোটেও আঘাত করে না । আরও কারণ নজরুলের গান রাগাশ্রয়ী | তাই সেখানে গায়কীর ব্যবহার ব্যবধান শ্রতিতে আঘাত করে- সুর বৈচিত্রর বৈচিত্রীয় প্রকাশ সহজেই শ্রোতাদের আকর্ষণ করে । যেমন নজরুলের ‘নহে নহে প্রিয় এ নয় আঁখি জল’
গানটি সকলেই শুনে থাকলে এবং সেই প্রথম থেকে আজ অবধি অসংখ্য শিল্পী গানটি কণ্ঠে ধারণ করেছে এবং প্রতি শিল্লীই তার কণ্ঠে গায়কীর ব্যবহার করেছেন । তৃপ্ত হয়েছেন। নজরুল কর্তৃক এই গায়কীর প্রবর্তনে শিল্পী-স্বাধীনতাও ছুটে এসে যুক্ত হয়েছে। নায়কী প্রথার গায়কী আর গায়কী প্রথার গায়কী এই দুই ‘গায়কী’কে এক কাতারে শামিল করে দেখাটাই যত দুর্ভোগের কারণ- যাকে অশিক্ষিত সংগীত-আচরণ বলাটাই যুক্তিযুক্ত ।
রবীন্দ্রসংগীতের আগে তান পিছে তান মাঝে গান করে রবীন্দ্রসংগীতকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রবীন্দ্রসংগীত তান সহ্য করার মতো হজম করার মতো গান নয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই তার সংগীতে অলঙ্করণ পছন্দ করতেন না। তার ‘সংগীত-চিন্তা’ গ্রন্থটি পড়লে তো তাই জানা যায়। নজরুলের যে গানে তান-আলাপ নেই সে গানেও তান আলাপ যুক্ত করা যায় -কারণ ওতে সহ্য করার শক্তি আছে। রবীন্দ্রসংগীত বর্তমানে যেমন-তেমন পরিবেশিত হচ্ছে, তা কি রবীন্দ্রসংগীত হচ্ছে? বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী পঙ্কজ কুমার মল্লিক আকাশবাণী থেকে সংগীত শিক্ষার আসরে বাধ্য হয়ে যখন ‘ফুলের জলসায় নীরব
কেন কবি’ গানটি শেখাতে শুরু করলেন তখন বলেছিলেন–এ গান তার পক্ষে সঠিকভাবে শেখানো মুশকিল। কারণ এ গান রেওয়াজি কণ্ঠের দরকার । এর থেকেই রবীন্দ্রসংগীতের কণ্ঠ আর নজরুলসংগীতের কণ্ঠের আকাশ-পাতাল তারতম্য বোঝা যায়। রবীন্দ্রসংগীত প্রধানত খোলনির্ভর গান আর নজরুলসংগীত তবলানির্ভর। রবীন্দ্রসংগীত নাসিকা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় একাধিক পরিবেশনে একঘেয়ে হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক। সুরে উদাত্ত-উদার পরিসর কেবল নজরুলেই আছে। নজরুলের গানে সকল ধরনের সংগীতের লীলাক্ষেত্র আছে। নজরুলের গান আর রবীন্দ্রনাথের গান বিচারের কাজ আমার নয়। তবুও তৈরি হওয়া কান যতটুকু ধর্তব্য ততটুকু বলার চেষ্টা।
নজরুল ছিলেন শাস্ত্রীয় সংগীতানুরাগী এবং আধুনিক মনস্ক একজন মানুষ | সে প্রেরণাতেই উচ্চাঙ্গ সংগীতের সঙ্গে আধুনিকতার রস সংমিশ্রণ করে সৃষ্টি করেন নতুন এক ধারার । গান ও সুরকে নতুনত্ব এবং বৈচিত্রময় করে তোলাই ছিল নজরুলের উদ্দেশ্য । বিভিন্ন রাগ- রাগিণীর সংমিশ্রণ করে নতুন নতুন সুর সৃষ্টিই ছিল তাঁর গানের বৈশিষ্ট্য ।
যেমন রাগজয়ন্তী ও খাম্বাজ সুর এক করে নজরল গেয়েছেন-
ছাড়িয়া পরাণ নাহি চায়
তবু যেতে হবে হায়…
আবার নটমল্লার এবং ছায়ানট রাগ মিলিয়ে লিখেছেন…
হাজার তারার হার হয়ে গো
দলি আকাশ বীণার পলে।
এ তো গেল রাগের সংমিশ্রণ । তিনি বিভিন্ন রাগের চলনের ওপর তীর লেখা অঙ্কিত করেছেন। অর্থাৎ সেই রাগের সুর ও লয় ঠিক রেখে তিনি গানের কথা সাজিয়েছেন । যেমন-
সাজিয়াছো যোগী বল
কার লাগি তরুণ বিবাগী।
রাগ যোগী আবার রাগ দরবারি কানাড়াতে…
আজ ঘুম নাহি নিশি জাগরণ ।
রাগ মালকোষের ওপর সাজিয়েছেন…
গরজে গম্ভীর গগনে কম্ভু
কাটিতে সুন্দর নাচে সয়ম্ভু।
এছাড়া নজরুলের নিজস্ব সৃষ্টি রাগ খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল । যেমন তাঁর সৃষ্ট পিলু রাগের-
যাক না নিশি গানে গানে
জাগরণে জাগরণে
আজকে খুশির বান ডেকেছে
আমার মনে আমার মনে।
কাজী নজরুল ইসলাম দুটি রাগ-রাগিণী একদম নিজন্ব বলে অভিমত পোষণ করেছেন। রাগ দুটি হলো বেণুকা ও দোলনচাঁপা। এছাড়া বিদেশি সুর অবলম্বনে বিভিন্ন রাগাশ্রিত গান তো রয়েছেই। গায়কী এবং শিল্পী স্বাধীনতা যখন নজরুল গানে প্রবর্তিত হলো তার সঙ্গে ‘বৈঠকী’ প্রভাব অবলীলায় যুক্ত হয়ে গেল ।
গজল সংগীতের পরিবেশনে যে ধরনের পরিবেশ তৈরি দরকার সে ধরনটি হবে একটি ধোয়া ঘরময় সুগন্ধি সৃষ্টি করছে, শিল্পী গাইছে শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে গানের ছন্দে-তালে একাকার হয়ে কখনো এঙ্কোর , কখনো ফিনজুরো বলে শিল্পীকে উৎসাহ জোগাচ্ছে বাহবা, বাহবা বলছে; শিল্পীও মাথা নেড়ে হাত তুলে কণ্ঠ শৈলী প্রকাশে মাতোয়ারা হয়ে সংগীত পরিবেশনে একাকার তবলার চাটি, র্যালা, তুব তেহাইতে আসর জমাট । সংগীতের এমন বিশাল পথ সৃষ্টি নজরুল আগমনের পূর্বে কোথায় ছিল? জমিদাররা তো ছিল, কিন্তু সংগীত ছিল নায়কীনির্ভর । নজরুল গজল গানের সুরেই প্রথম রাগের ব্যবহার করেন, যা ক্রমশ বিচিত্র ও ব্যাপক হয়। তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত গজল হলো : আসে বসন্ত ফুলবনে’ (ভীমপলশ্রী), ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ (ভৈরবী), ‘দুরস্ত বায়ু পুরবইয়া’ (কাফি-সিন্ধু), ‘এত জল ও কাজল চোখে” (মান্দ), ‘ভুলি কেমনে আজো যে মনে” (পিলু), ‘কার নিকুঞ্জে রাত কাটায়ে’ (গারা-ভৈরবী), ‘কেন কাঁদে এ পরাণ’ (মিশ্র বেহাগ-খাম্বাজ), ‘চেয়ো না সুনয়না’ (বাগেশ্রী পিলু), ‘বসিয়া নদী কূলে’ (কালাংড়া) ইত্যাদি । নজরুলের প্রথম দিককার গজলগুলোর অধিকাংশই কৃষ্ণনগরে রচিত। সে সময় নজরুল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ দিলীপ কুমার রায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন । নজরুলের গজলগুলো জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে দিলীপ কুমারের সক্রিয় ভূমিকা ছিল৷ দিলীপ কুমার রায় ছিলেন রাগসংগীতে পারদশী, তাই তার কণ্ঠে রাগাশ্রিত সুরে নজরুলের গজলগুলো রচয়িতার কাঙ্ক্ষিত রূপ লাভ করে।
শুধু গজল নয়, নজরুলের সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী স্বদেশি গান “দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ বা ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’ দিলীপ রায় তার সহশিল্পীদের নিয়ে প্রথম পরিবেশন করেন ১৯২২ সালের ২২ মে কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীত রূপে। ১৯২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম নজরুলের গান রেকর্ড হলেও (শিল্পী : হরেন্দ্রনাথ দত্ত, গীত : ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব) এবং ১৯২৬ সাল থেকে নজরুল গজল রচনা করলেও ১৯২৮ সালের মার্চ মাসের আগে তিনি প্রত্যক্ষ বা নিয়মিতভাবে গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। নজরুল ওস্তাদদের সংস্পর্শে এসেছিলেন গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ এবং কলকাতা বেতারে সংশ্রিষ্ট হওয়ার পরে. কিন্তু তার আগেই যে তিনি রাগসংগীতে ব্যুৎপন্ন ছিলেন, সে পরিচয় পাওয়া যায় ১৯২৬-২৮ সালের মধ্যে রচিত তাঁর গজল ও গান থেকে। তাঁর বুলবুল (১৯২৮), চোখের চাতক (১৯২৯) এবং চন্দ্রবিন্দু (১৯৩০) গীতি-সংকলনের অধিকাংশ গানের সুরই রাগনির্ভর। বুলবুলের গানগুলো গজল আঙ্গিকে হলেও চোখের চাতক এবং চন্দ্রবিন্দুর গান গুলো গজল ছাড়াও অন্যান্য আঙ্গিকের । বোঝা যায় যে, ১৯৩০ সালের মধ্যেই নজরুল তার বিভিন্ন আঙ্গিকের গানের সুরে রাগ-রাগিনী ও তালের ব্যবহারে পারদর্শী হয়ে ওঠেন । নজরুলের ১৯২৬-২৭ সালে রচিত গজলগুলো পরবর্তীকালে কে মল্লিক, আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, হরিমতি, রাধারাণী প্রমুখ শিল্পীর কষ্টে রেকর্ড হয়। তাঁর গানে কেবল প্রেম নয় দর্শন আর সমসাময়িক সময়ের উৎক্ষেপণও ক্রিয়াশীল ছিল ।
কবি ও সাহিত্যিক, গীতিকার ও সুরকার, সমাজ সংস্কারক, রাজনৈতিক কর্মী কিংবা ব্যক্তি হিসেবে নজরুল বিচার ও মুল্যায়ন হয়েছে, অনেকে করেছেন। সেইসব লেখালিখির মধ্যে তাঁকে নিয়ে সমাজের সমাজের নানা শ্রেনীর, নানান সম্প্রদায়ের ও নানান অংশের চিন্তা ও উৎকণ্ঠা ধরা পড়ে । সেই দিক থেকে নজরুল তাঁর সময়কালে এক ভাবে আলোচিত হয়েছেন সেই আলোচনার মধ্যে সেই সময়কালের অর্থনৈতিক সম্পর্কের পরিবর্তন, সমাজের নতুন পরিগঠন, রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা ইত্যাদির লক্ষণ বা উৎক্ষেপ রয়েছে। তাকে নিয়ে আলোচনার সময় সেই লক্ষণ বা উৎক্ষেপগুলোই সামনে আসে-সেটাই স্বাভাবিক ।ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে এখনকার সময় অবধি বাংলাদেশের জনগণের, আবেগ কল্পনা, আত্মচিন্তা ও আত্মপরিচয়ের টানাপড়েন ও বিবর্তন বোঝার জন্য নজরুল অসামান্য সামাজিক উপাদান। সেইদিকে বাংলাদেশে তাঁর সম্পর্কে আগ্রহ আছে ঠিকই, কিন্তু খুব একটা কাজ হয়েছে বলে মনে হয়না । তাঁর গান ও সাহিত্যকর্ম নিয়েই আমাদের আগ্রহ বেশি । তাঁর জীবনকে গান ও সাহিত্যকর্মের আলো ফেলে আমরা বোঝার চেষ্টা করি । এতেও অবাক হবার কিছু নেই । এটাই প্রাথমিক ভাবে হবার কথা । কিন্তু উল্টো দিক থেকে তাঁকে বোঝার চেষ্টা করি না। একটি জনগোষ্ঠীর বেড়ে ওঠার ইতিহাসের সঙ্গে তার লেখালিখি ও সংগীত কিভাবে জড়িত সেই দিকটা এখনো অনালোচিতই থেকে গেছে।
নজরুল নিয়ে আমাদের বিপুল আগ্রহ থাকলেও তার তাৎপর্য নিয়ে বাংলাদেশে আমরা যথেষ্ট ভেবেছি বলে মনে হয় না। আরও একটি কারণে তাকে একপেশে রেখে চলার প্রবণতা আয়াদের প্রকট। তা হলো হিন্দু না তিনি মুসলিম । কিন্তু যে নজরুল ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে যে জনগোষ্ঠীকে কল্পনা করতে চেয়েছিলেন সেখানে হিন্দু মুসলমান ভেদ ছিলনা । অথচ বান্তবে সেই ভেদ তৈরি হয়ে গিয়েছিল, তাঁর লেখালিখির মধ্যে দুই সম্প্রদায়ের প্রতি অতএব আলাদা আবেদন প্রস্তাব করবার তাগিদ ছিল। কখনো তিনি ‘হিন্দু’ হয়ে লিখেছেন, কখনো ‘মুসলমান’ হয়ে । দুই সম্প্রদায়ের আশা আকাঙ্ক্ষা ও অভিপ্রায় তখন এক বিন্দুতে বা এক কাতারে ছিল, ইতিহাস তা বলেনা । আমরা বাংলাভাষা, সংস্কৃতি ও বাঙালি পরিচয়কে হিন্দু মুসলমান ভেদাভেদ থেকে আড়াল করে রাখতে চাই । যা আসলে অবাস্তব ও অনৈতিহাসিক । তাঁর শ্যামাসঙ্গীত বা কীর্তন রচনাকে নিছকই সাহিত্যিকচর্চা হিসেবে গণ্য করার সুযোগ নেই । কারণ তা ওই ভেদহীন সমাজ রচনা করার লক্ষ্যেই । তর্ক করব না, তুলনাও করছি না, রবীন্দ্রনাথ তো বাঙালি হয়েও ‘ইসলামী সঙ্গীত’ রচনা করেননি । তাই বলে তিনি সাম্প্রদায়িক ছিলেন তাও না । এটা কূট তর্ক বলে পরিহার করতে পারি, কিন্তু এটাই ইতিহাস । হিন্দু মুসলমান ভেদকে বাস্তব ও ঐতিহাসিক বলার অর্থ এই নয় যে, এই ভেদ প্রাকৃতিক; অতএব চিরায়ত । অর্থাৎ হিন্দু কিংবা মুসলমানকে এই ভেদবুদ্ধির জন্য দোষারোপ না করে এই
ভেদ তৈরি হবার ঐতিহাসিক কারণগুলোকে বোঝা । এবং অতীতের ভুলের পূর্বানুবৃত্তি বন্ধ করা । “এখন আমাদের বাঙলা সাহিত্যে স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করিতে হইলে সর্বপ্রথম আমাদের লেখার জড়তা দূর করিয়া তাহাতে ঝর্ণার মতো ঢেউ ভরা চপলতা ও সহজ মুক্তি আনিতে হইবে। যে সাহিত্য জড়, যাহার প্রাণ নাই, সে নির্জীব সাহিত্য দিয়া আমাদের কোন উপকার হইবে না, আর তাহা স্থায়ী সাহিত্যও হইতে পারে না। বাঙলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া খুব কম লেখকেরই লেখায় মুক্তির জন্য উদ্দাম আকাঙ্ক্ষা ফুটিতে দেখা যায়”- বাঙলা সাহিত্যে মুসলমান (নজরুল ইসলাম, ১৯৬৬, পৃষ্ঠা-৮২০) যেখানে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই ছিলেন নজরুলের প্রেরণা সেখানে আজ আমাদের কেন গান রচনা – ‘একদিকে রবীন্দ্রনাথ, একদিকে নজরুল’ । সাহিত্যে, সংগীতে বাঙালির চেতনায় এই দুই মহীরুহ আমাদের কেবল প্রেরণা নয় মূল শেকড়। হিন্দু-মুসলমান মিলনে বিশ্বাসী নজরুল নিজেই বলেছেন, ‘বাংলা সাহিত্য হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই সাহিত্য, এতে হিন্দু দেব-দেবীর নাম দেখলে মুসলমানের রাগ করা যেমন অন্যায়, হিন্দুদেরও তেমনি মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের মধ্যে নিত্য-প্রচলিত মুসলমানী শব্দ তাদের লিখিত সাহিত্য দেখে ভ্রু কুঁচকানো অন্যায়।”তিনি অধ্যক্ষ ইবরাহীম খাকে লিখিত এক পত্রে উল্লেখ করেন, “আমি হিন্দুমুসলমানদের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী… । তাই তাদের এ সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানী শব্দ ব্যবহার করি বা হিন্দু দেব-দেবীর নাম নেই ।” তাই আমাদের মনে রাখতে হবে বিদ্রোহী ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শুধু পরাধীনতার বন্ধন মুক্তির, পুরানো সমাজ ভেঙে নতুন ও উন্নত সমাজ গঠনের স্বপ্নই দেখেননি, তিনি বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিভেদের এবং সংকীর্ণতার আগল ভেঙে নতুন ঐতিহ্য গড়ার ধারা সৃষ্টি করে গেছেন, রেখে গেছেন অনুপ্রেরণাদায়ক দৃষ্টান্ত ।
বিশ শতক পেরিয়ে আমরা একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে প্রবেশ করেছি। এরই মধ্যে সাম্রাজ্যবাদের বদলে এসেছে বিশ্বায়ন, ঔপনিবেশিক শোষণের স্থান নিয়েছে মুক্তবাজার অর্থনীতি, জাতীয় সংস্কৃতিকে গ্রাস করে ফেলেছে আকাশ সংস্কৃতির বিকিরণে অপসংস্কৃতির বাতাবরণ। আজ তৃতীয় বিশ্বের সবচেয়ে জটিল সমস্যা ওই প্রভুত্ব থেকে স্বকীয়তা অক্ষুন্ন রাখা আর সে জন্য প্রয়োজন একই সঙ্গে স্বদেশি ও আন্তর্জাতিক হওয়া। নিজের জাতিসত্তার ও সংস্কৃতির প্রতি অবিচল থেকে আন্তর্জাতিক হওয়া। আজকের পৃথিবীতে কোনো দেশ-জাতি নির্জন দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। আজ তাকে নিজের
মাটিতে আপন ঐতিহ্যের শেকড় গভীর থেকে গভীরে প্রোথিত করে দাঁড়াতে হবে। নজরুলের মতো বলতে হবে, ‘বল বীর–/বল উন্নত মম শির/শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির’ । আমাদের বেলা অবেলা আর চেতনাবোধে নজরুল হয়ে উঠুক আরও ব্যাপক চর্চাকেন্দ্র।
দোহাইঃ
১. আব্দুল কাদির (১৯৬৬), নজরুল রচনাবলী, ঢাকা : বাংলা একাডেমী
২. ইসলাম, কাজী নজরুল (১৯৮৪), নজরুল রচনাবলী, চতুর্থ খণ্ড ঢাকা : বাংলা একাডেমী
৩. চক্রবর্তী, জ. (২০০৩), বাঙলা ভাগ হোল : হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও দেশবিভাগ, ১৯৩২-১৯৪৭,
ঢাকা: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড
৪. নজরুল ইসলাম (১৯৬৬), নজরুল রচনাবলী, প্রথম খন্ড, ঢাকা: বাংলা একাডেমী
৫. বাঙলা সাহিত্যে মুসলমান
৬. নজরুল প্রসঙ্গ : বাংলা একাডেমী